কাশ্মীরের ইতিহাস শেষ ডোগরা রাজা



ভূস্বর্গ থেকে বহু দূরে সবার চোখের আড়ালে মৃত্যু হয়েছিল কাশ্মীরের শেষ ও বিস্মৃত ডোগরা রাজা !
পরাধীন ভারতের আর পাঁচজন দেশীয় রাজার মতো তিনিও একজন। কিন্তু তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তিনি, রাজা হরি সিংহ। কালের স্রোতে এত দিন ছিলেন বিস্মৃত। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ সংক্রান্ত প্রসঙ্গে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে তার নাম।
ডোগরা রাজপুত বংশে হরি সিংহের জন্ম ১৮৯৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। এই ডোগরা বংশ প্রথমে ছিল শিখ শাসকদের সেনাদলে। তারপর ব্রিটিশদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে সম্বল করে ক্ষমতাদখল করে।
 ১৮৪৬ সাল নাগাদ শিখদের পরে তারাই হয়ে ওঠে উপত্যকার শাসক। প্রথম শাসক ছিলেন গুলাব সিংহ জামওয়াল।
গুলাব সিংহের উত্তরাধিকার-ধারায় রাজা অমর সিংহ জামওয়ালের পুত্র হরি সিংহ। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। সেই অবস্থায় তার শিক্ষার দায়িত্ব নেয় ব্রিটিশ সরকার। মেজর এইচকে ব্রার ছিলেন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত তার অভিভাবক। ব্রিটিশদের উদ্যোগে তিনি অজমেঢ়ের মেয়ো কলেজ থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। এরপর তার সেনা-প্রশিক্ষণ হয় দেহরাদূনের তৎকালীন ইম্পেরিয়াল ক্যাডেট কর্পস-এ।।
১৯১৫ সালে তিনি কম্যান্ডার-ইন-চিফ অব দ্য স্টেট ফোর্স নিযুক্ত হন। অন্যদিকে বেশির ভাগ রাজার মতো তার জীবনও ছিল বিলাসব্যসনে ভরা। চার বার বিবাহ হয়েছিল হরি সিংহের। বিয়ের দু’বছর পরে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মারা যান তার প্রথম রানি। তারপর দ্বিতীয় বিবাহ। পাঁচ বছরের দাম্পত্যের পরে মৃত্যু হয় নিঃসন্তান দ্বিতীয় মহিষীর।
তৃতীয় রানিও ছিলেন সন্তানহীনা। পুত্রসন্তানের জন্ম দেন চতুর্থ রানি, কাংড়ার তারা দেবী সাহিবা। বিয়ের তিন বছর পরে ১৯৩১ সালে জন্ম হয় হরি সিংহ ও তারা দেবীর একমাত্র পুত্র কর্ণ সিংহের। তবে ১৯৫০ সালে ভেঙে যায় রাজা হরি সিংহের চতুর্থ বিয়ে, ২২ বছরের দাম্পত্যের পরে।।
কাকা প্রতাপ সিংহের মৃত্যুর পরে ১৯২৫ সালে সিংহাসনে অভিষেক হয় হরি সিংহের। তিনি নিজের রাজত্বে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। আইন জারি করেছিলেন বাল্যবিবাহ রোধে। নিম্নবর্গের জন্য খুলে দিয়েছিলেন ধর্মস্থানের দরজা।
রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে চেয়েছিলেন হরি সিংহ। তিনি মুসলিম লিগের বিরোধিতা করেছিলেন। আবার কংগ্রেস বা জওহরলাল নেহরুরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। বরং, নেহরুর কাছের ছিলেন কাশ্মীরের তৎকালীন নেতা শেখ আবদুল্লা।।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে হরি সিংহ-ই ছিলেন কাশ্মীরের ক্ষমতায়। কিন্তু জম্মু কাশ্মীর কোন দিকে যাবে, ভারত না পাকিস্তান, সে প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। ভারত বা পাকিস্তান কোনো দিকেই অন্তর্ভূক্ত করতে চাননি তার প্রজাদের।
কিন্তু নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হলেন তিনি। তৎকালীন নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স বা আজকের খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাড়াতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
পরিস্থিতির ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাসেশনে স্বাক্ষর করেছিলেন মহারাজা হরি সিংহ। ফলে জম্মু কাশ্মীর অংশ হল স্বাধীন ভারতের। কিন্তু এই ঘটনার ফলে শুরু হল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
ঘটনাপ্রবাহ এবং পরিস্থিতি সবই হরি সিংহের জন্য বন্ধুর হয়ে ওঠে। তিনি বাধ্য হন ছেলে কর্ণ সিংহকে যুবরাজ ঘোষণা করতে। তবে তার নামের পাশে ‘রাজা’ পরিচয় বহাল ছিল ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়া অবধি।
পরিস্থিতির চাপে কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য হন হরি সিংহ। ক্ষমতায় আসেন ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আবদুল্লা। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে হরি-পুত্র কর্ণ সিংহ ১৯৫২ সালে নিযুক্ত হন ‘সদর-এ-রিয়াসৎ’ বা ‘হেড অব স্টেট’ এবং ১৯৬৪ সালে ‘গভর্নর অব স্টেট’।
ক্ষমতাচ্যুত হরি সিংহের জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল আরবসাগরের তীরে সাবেক বম্বে শহরে। সেখানেই প্রয়াত হন ১৯৬১ সালের ২৬ এপ্রিল। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তার চিতাভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জম্মু ও কাশ্মীরে। অস্থি বিসর্জন করা হয়েছিল জম্মুর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তাওয়ই নদীতে....
Powered by Blogger.